আনলিমিটেড ডেস্ক নিউজঃ রাজধানীর মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের ইজারার টাকা চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে সিটি কর্পোরেশনকে (ডিএনসিসি) পরিশোধ করেনি স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি গাজী মেসবাউল হোসেন সাচ্চুর প্রতিষ্ঠান। পরে ঐ প্রতিষ্ঠানকে বকেয়া টাকা কিস্তিতে পরিশোধের জন্য সময় দেয় সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু নতুন করে দেওয়া সময়ের মধ্যেও টাকা দেননি গাজী রাইয়ান এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী গাজী মেসবাউল হোসেন সাচ্চু।
চুক্তি ভাঙলেও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ডিএনসিসি। উল্টো তার কাছেই নতুন করে বাস টার্মিনালটির ইজারা দেওয়া হয়েছে।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় (ভ্যাট-আয়করসহ ৪ কোটি ৬২ লাখ) মহাখালী বাস টার্মিনালের ইজারা গাজী রাইয়ান এন্টারপ্রাইজকে দেয় ডিএনসিসি। ইজারাদার প্রতিষ্ঠানটি গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চুর। এক বছর মেয়াদি ঐ ইজারা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে মেয়াদ তিন মাস বাড়ানোর আবেদন করেন ইজারাদার। আবেদন অনুযায়ী ঠিকাদারকে ঐ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়।
২০২২ সালের এপ্রিলে আগের ইজারামূল্যের বিনিময়েই সাচ্চুর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরো ১ বছরের জন্য ইজারা চুক্তি নবায়ন করে সিটি কর্পোরেশন। তবে এ দফায় তিনি ঠিকমতো ইজারার টাকা পরিশোধ করেননি। ইজারার নির্ধারিত মেয়াদ ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে তিনি ২ কোটি ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। সেই হিসাবে বকেয়া ছিল ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
বকেয়া এই টাকা পরিশোধে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে বাড়তি সময় দেয় সিটি কর্পোরেশন। ৮ কিস্তিতে ঐ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করতে বলা হয়। কিন্তু ইজারাদার দুই কিস্তিতে মাত্র ৪৩ লাখ টাকা পরিশোধ করার পর সিটি কর্পোরেশনকে আর টাকা দেননি। ফলে তার কাছে কর্পোরেশন আরো ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা পাবে।
এভাবে চুক্তি লঙ্ঘন করার পরও সাচ্চুর প্রতিষ্ঠানের কাছেই আরো এক বছরের জন্য (২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত) বাস টার্মিনালটির ইজারা দেওয়া হয়েছে। নতুন ইজারার কার্যাদেশ দেওয়া হয় গত ১২ মার্চ। এ কার্যাদেশ দেওয়ার আগেই কৌশলে সাচ্চুকে আরো ৫ মাস অর্থাৎ মে পর্যন্ত বকেয়া পরিশোধের সময় দেয় ডিএনসিসি।
এবারের ইজারার পরিমাণ আগের দুইবারের চেয়েও দেড় কোটি টাকা কম
ডিএনসিসির পরিবহন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সরকারিভাবে ২ কোটি ৩৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ইজারামূল্য নির্ধারণ করে গত আগস্টে মহাখালী বাস টার্মিনালের ইজারায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। গাজী রাইয়ানসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান টার্মিনালের জন্য দরপত্র দিয়েছিল। কিন্তু কোনোটিই সরকারি দরের চেয়ে বেশি দেয়নি।
কাঙ্ক্ষিত দর না পেয়ে দ্বিতীয় দফায় গত ২২ অক্টোবর আবার দরপত্র আহ্বান করে ডিএনসিসি। সেবার শুধু সাচ্চুর প্রতিষ্ঠান গাজী রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ দরপত্রে অংশগ্রহণ করে ও ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দর দেয়; যা সরকারি দরের চেয়ে মাত্র ৩৫ হাজার টাকা বেশি। পরে প্রতিষ্ঠানটিকেই চূড়ান্ত করে গত ১২ মার্চ কার্যাদেশ দেয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
অথচ ২০২১ ও ২০২২ সালে দুই দফার প্রতিবারই টার্মিনালটির ইজারামূল্য ছিল ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। কিন্তু বর্তমানে যে টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে, সেটি আগের মূল্যের চেয়ে ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা কম।
ডিএনসিসির পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের এপ্রিল থেকে নতুন করে ইজারা দেওয়ার আগ পর্যন্ত মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সিটি কর্পোরেশন খাস আদায় করে। খাস আদায়ের ৯ মাসের মধ্যে (২০২৩ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে গত ২৮ জানুয়ারি) টার্মিনাল থেকে সিটি কর্পোরেশনের আয় হয় ২ কোটি ৩৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা; যা নতুন ইজারামূল্যের চেয়ে কিছু বেশি।
চুক্তি ভঙ্গ করলেও সাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ
২০২১ সালের জানুয়ারিতে গাজী মেজবাউল হোসেনের সঙ্গে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের বাস টার্মিনাল ইজারা সংক্রান্ত চুক্তি হয়। চুক্তির ৪ নম্বর শর্ত অনুযায়ী, ইজারামূল্যের টাকা ৪টি কিস্তিতে (সমান ভাগে) পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম কিস্তির টাকা চুক্তির আগে দিতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তি কার্যাদেশ দেওয়ার (চুক্তির মেয়াদ শুরুর) ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। তৃতীয়টি ১৮০ দিনে ও চতুর্থটি ২৭০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
চুক্তিরই ২১ নম্বর শর্তে উল্লেখ ছিল, ইজারাদার চুক্তির যেকোনো শর্ত ভাঙলে সিটি কর্পোরেশন ইজারা বাতিল করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে। কিন্তু অজানা কারণে চুক্তির শর্তভঙ্গের পরও ইজারাদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ইজারাদার ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাতেই ঐ নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া রাজনৈতিক বিষয়টি বিবেচনা করেই সর্বশেষ দরপত্রের শর্তেও অতীতে খেলাপি ইজারাদারের বিষয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না।
নিয়ম মেনেই দেওয়া হয়েছে নতুন ইজারা!
ডিএনসিসির পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সিটি কর্পোরেশন কয়েক দফা সময় দেওয়ার পরও স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি গাজী মেসবাউল হোসেন সাচ্চুর প্রতিষ্ঠান গাজী রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ আগের বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। এরপরও আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন করে সময় দেওয়া হয়েছে যেন টাকাটা উঠে আসে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বকেয়া টাকা না উঠলে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, বিগত বছরগুলোর মতো এবারও সব নিয়ম মেনেই গাজী রাইয়ান এন্টারপ্রাইজকে মহাখালী বাস টার্মিনালের ইজারা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। এখানে আমাদের কোনো লোকচুরি নেই। প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করেই ইজারে পেয়েছে।
এসব বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি গাজী মেজবাউল হোসেন বলেন, এটা মেয়র মহোদয় আমার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন। এইটুকুই, আর কিছু না। আমি কখনোই দলীয় প্রভাব দেখিয়ে কোনো কিছু করতে চাই না। কখনো দলের নাম বিক্রি করে কোথাও কিছু করেছি, এ রকম কোনো প্রমাণ পাবেন না।
ইজারা নিয়ে অনেক টাকা লোকসান হওয়ার কারণেই বকেয়া রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আগের বকেয়া পরিশোধে ইজারাদারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী মে মাস পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। ঐ সময়ের মধ্যে বকেয়া আদায়ে পরিবহন বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইজারাদার বকেয়া পরিশোধ না করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে সর্বোচ্চ দরদাতাকে বাস টার্মিনালের ইজারা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এবার কার্যাদেশ দেওয়ার আগেই ইজারার পুরো টাকা নিয়ে নেয়া হয়েছে।
Leave a Reply