আনলিমিটেড নিউজ ডেস্কঃ আবারও পেছানো হয়েছে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে যাবার দিনক্ষণ। ২০২৩ সালে প্রথম দফায় পেছানোর পর চলতি বছরের ডিসেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বেশ কয়েক মাস বিদ্যুৎ এর সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্পটির দায়িত্বে থাকা শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যেতে আরও কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগবে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
গ্যাস ও কয়লা সংকটে ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। বকেয়া অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থায় অনেকেই তাকিয়ে ছিলেন ডিসেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনের দিকে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সঞ্চালন লাইন পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় সেটিও এখন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সামনের দিনগুলোতে বিদ্যুৎ সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বছরখানেক আগেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লিসহ মূল অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এমনকি গত বছরের অক্টোবরে রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানির প্রথম চালানও বুঝে পেয়েছে সরকার। কিন্তু গ্রিড বা সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হওয়ায় উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হয়নি।
এর কারণ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো নয়। এটি একবার চালু করা হলে পরে চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করা যায় না। মূলত সেই কারণেই চলতি বছরের শুরু থেকেই দ্রুত সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত করার প্রতি জোর দিয়ে আসছিলেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
সরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের অধীনে এই সঞ্চালন লাইন তৈরি করছে ভারতের তিনটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো: কেইসি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ট্রান্সরেল লাইটিং লিমিটেড এবং লারসেন অ্যান্ড টুব্রো লিমিটেড। পরিকল্পনা ছিল চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ করে ডিসেম্বরে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাওয়ার।
পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুর রশিদ খান বলেন, প্রথম ছয় মাসে কাজের অগ্রগতিও ছিল সন্তোষজনক। কিন্তু পরে দেশের পরিস্থিতির কারণে সেই ধারা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি।
মূলত গত জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতাকে ঘিরে সারা দেশে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, সেটির জেরেই সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজে ধীরগতি দেখা দেয়। আর ৫ আগস্টের পর কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের উপ-স্কিম পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ভারত, সিঙ্গাপুর, তুরস্কসহ অন্য দেশের যেসব নাগরিকরা সঞ্চালন লাইন নির্মাণের মূল কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, নিরাপত্তা শঙ্কায় তারা সবাই নিজ নিজ দেশে ফিরে যান।
আবদুর রশিদ খান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছিলাম। নিরাপত্তা ইস্যু নিশ্চিত হওয়ার পর অক্টোবরের শেষের দিকে তারা প্রায় সবাই আবারও কাজে যোগ দেয়। কিন্তু টানা তিন মাস কোনো কাজ না হওয়ায় ততদিনে আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। যার ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গ্রিড লাইন পুরোপুরি রেডি করা সম্ভব হয়নি।
এক লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাজেটের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দু’টি ইউনিট বা চুল্লি রয়েছে। এর প্রতিটি ইউনিট প্রায় ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম বলে জানা যাচ্ছে।
প্রথম ইউনিটটি চালু করার লক্ষ্যে রূপপুর-গোপালগঞ্জ রুটে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের গ্রিড লাইন নির্মাণ করছে পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ, যার মধ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার পড়েছে পদ্মা নদীতে। রশিদ খান বলেন, নদীর দু’পাশে স্থলভাগে লাইনের প্রায় ৯৬ শতাংশের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। বাকি অংশের কাজ আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তবে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে নদী অংশের কাজ।
এই বিষয়ে দেলোয়ার হোসেন বলেন, নদী অংশে এখনও প্রায় ৪৫ শতাংশের কাজ বাকি। তীব্র স্রোত ও পলিমাটির কারণে কাজ এগিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
পদ্মার ওপর দিয়ে গ্রিড লাইন নেওয়ার জন্য মূলত চারটি টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে দু’টি নির্মাণ করা হচ্ছে দুই তীরে। বাকি দু’টো পড়েছে নদীর ভেতরে।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, সার্বিকভাবে নদীর দু’পাশের তীরের টাওয়ারের পাইলিংয়ের কাজ ৭৫ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। আর নদীর ভেতরে দুই টাওয়ারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৫০ শতাংশ।
পুরো নির্মাণ কাজ শেষ করতে আরও অন্তত চার মাস সময় লাগবে বলে জানাচ্ছেন কর্মকর্তারা। আবদুর রশিদ খান বলেন, আমাদের টার্গেট আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে প্রথম ইউনিটের সঞ্চালন লাইনের কাজ পুরোপুরি শেষ করা। সেভাবেই আমরা এখন পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আশাকরি ওই সময়ের মধ্যেই আমরা লাইন রেডি হয়ে যাবে।
নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী বছরের মার্চে প্রথম ইউনিটের গ্রিড লাইনের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে বলে জানাচ্ছেন প্রকল্পের শীর্ষ কর্মকর্তারা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছান বলেন, লাইন রেডি হওয়ার পর উৎপাদনে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে।
সাধারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস, কয়লা বা তেল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলেও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফুয়েল পোড়ানো হয় পারমাণবিক চুল্লিতে ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে যেখানে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস বিভাজন ঘটে। যার ফলে প্রচুর তাপ শক্তি উৎপন্ন হয়। এই তাপশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে পানিকে বাষ্পে পরিণত করে তারপর টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
পারমাণবিক চুল্লিতে এটি একধরনের নিয়ন্ত্রিত ‘চেইন রিয়্যাকশন’ হয় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা আরও জানাচ্ছেন যে, জ্বালানি হাতে পেলেই যেমন হুট করে চুল্লিতে সেটি ঢুকিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়া যায় না, তেমনি একবার চালু করার পর সেটি সহজে আবার বন্ধও করা সম্ভব না। জাহেদুল হাছান বলেন, মূলত সেই কারণেই সব ধরনের প্রস্তুতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে তারপরে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়া হয়।
এক্ষেত্রে প্রাথমিক বিভিন্ন পরীক্ষা শেষ করে জ্বালানি লোড করতে দুই মাসের মত সময় প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। এরপর পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে আরও এক মাস সময় লাগবে। জাহেদুল হাছান বলেন, এর মানে, আগামী বছরের মার্চের মধ্যে গ্রিড রেডি হলে থার্ড কোয়ার্টারে, অর্থাৎ জুলাই-অগাস্টের দিকে হয়তো টেস্ট ট্রায়ালে যাওয়া সম্ভব হবে। আর প্রথম ইউনিট চালু হওয়ার এক বছর পর অর্থাৎ ২০২৬ সালের শেষ দিকে দ্বিতীয় চুল্লি চালু করা সম্ভব হবেও বলে আশা করছেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলার ও জ্বালানি সংকটের মুখে বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতে যে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি থেকে পরিত্রাণের একটা বড় আশার জায়গা হলো ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেন, আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী যেহেতু ২০২৫ সালের গ্রীষ্মের আগেই সেখানে উৎপাদন শুরু করা সম্পন্ন হচ্ছে না, সেহেতু বিদ্যুৎ পরিস্থিতিতেও উন্নতির তেমন কোনো আশা আপাতত নেই বলা যায়।
বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে গ্রীষ্মকালে। ওই সময় চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছায় বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এর বিপরীতে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ প্রায় ৩১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে বলে জানাচ্ছেন কর্মকর্তারা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। চলতি বছরে গ্রীষ্মে বিভিন্ন জেলায় ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টাও লোডশেডিং হতে দেখা গেছে।
সক্ষমতা থাকার পরও মূলত জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না সরকার।অন্যদিকে, ডলার সংকটে ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। আদানি গ্রুপের মালিকানাধীন যে প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেয়ে আসছিল, সেখানেও বড় অঙ্কের বকেয়া পড়ে গেছে।
বেশ কয়েক বার তাগাদা দেওয়ার ওই বকেয়া পরিশোধ না করায় সম্প্রতি বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়েও দিয়েছে আদানি পাওয়ার। এমনকি দ্রুত অর্থ পরিশোধ না করলে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে বলেও ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেন, কাজেই সংকট বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আগামী বছর গ্রীষ্মে আরও খারাপ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
Leave a Reply